শাইখে ভানুগাছী রাহ. ও শায়খ নজরুল ইসলাম
আঞ্জুমানে তা’লীমুল কুরআন বাংলাদেশ

শাইখুল কুররা মাওলানা আলী আকবর সিদ্দিক শাইখে ভানুগাছী রহ. একটি সংগ্রাম, একটি ইতিহাস। কুরআনের সহিহ তা’লীমের জন্য সারাজীবন কাজ করে গেছেন। তিনি মরেও অমর। বৃহত্তর সিলেট থেকে শুরু করে সারা বাংলাদেশে শুদ্ধ কুরআন শিক্ষা দানের এক মহান শিক্ষক ও উদ্যোক্তা। দেশের বাইরেও কার্যক্রম চলছে আলহামদুলিল্লাহ।
কাল থেকে আঞ্জুমানে তা’লীমুল কুরআন বাংলাদেশের রমজানভিত্তিক কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। আঞ্জুমানের প্রধান গোল ও মিশন হচ্ছে সর্বত্র বিশুদ্ধ কুরআন শিক্ষার প্রশিক্ষণ জারি করা। এ ক্ষেত্রে রমজানকে সামনে রেখে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। রমজানে আঞ্জুমানের অধীনে প্রায় ২ হাজার কেন্দ্রে সহিহ কুরআন শিক্ষা প্রদান করা হয়। পাশাপাশি সারাবছর আঞ্জুমান পরিচালিত অন্যান্য প্রকল্পও চালু থাকে।
আঞ্জুমান প্রতিষ্ঠার লম্বা ইতিহাস আছে। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠাতার আত্মজীবনীতে প্রকাশ পাবে ইনশাআল্লাহ। সহজ করে বললে সময়ের প্রয়োজনে, বিবেকের তাড়নায় এবং মানুষকে সহিহ কুরআন শিক্ষার মহান খেদমত আঞ্জাম দিতে আজ থেকে ৪৩ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৮২ সালে আঞ্জুমানে তা’লীমুল কুরআন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়।
শাইখুল কুররা মাওলানা আলী আকবর সিদ্দিক রাহ. [পীরসাহেব ভানুগাছী] রাহ. এর অক্লান্ত ত্যাগ ও পরিশ্রম আর শেষ রাতের কান্যায় গড়ে উঠেছে আঞ্জুমান নামক মহান এ কুরআন শিক্ষার দুর্গ। টাকার ইনভেস্ট আর ফেসবুক পোস্টে আঞ্জুমান প্রতিষ্ঠা হয়নি; চূড়ান্ত ইখলাস আর নিরন্তর প্রচেষ্টায় এ বাগান তৈরি হয়েছে। কৃত্রিমতার কোনো স্থান ছিলো না।
যাইহোক এসব ব্যাপারে ভিন্ন আলাপে আরো বলা যাবে। শাইখুল কুররা মাওলানা আলী আকবর সিদ্দিক ভানুগাছী রাহ. ৮ মার্চ ২০১৬, মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ছ’টায় মওলার ডাকে সাড়া দিয়ে এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। নিয়মতান্ত্রিক সেদিন সর্বশেষ রাতে আমি পাশে ছিলাম। ফজর পড়ে এসে খবরটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না 😪। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। মহান আল্লাহ বাবাকে জান্নাতে ভালো রাখুন। সবার দুআ প্রত্যাশী।
২০১৬ সালে আব্বার ইন্তেকালের পর আঞ্জুমানের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন লেখক, গবেষক ও বিচক্ষণ মানুষ কারী মাওলানা শাহ মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম হাফিজাহুল্লাহ। পরবর্তীতে নির্বাচিত হয়ে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮ বছর আঞ্জুমানের সভাপতিত্ব করেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর দ্বারা আঞ্জুমানের কোনো ক্ষতি হতে দেখিনি। এবং তাঁকে সর্বাধিক যোগ্যও মনে হয়েছে।
আমাদের বাপ-চাচারা যাদেরকে সম্মান দেন আমারা তাঁদেরকে যথাযথ সম্মান দেখাতে পারি না। আমার খুব ভালো করে মনে আছে আব্বা রাহিমাহুল্লাহ শাহ নজরুল ইসলাম সাহেবকে কতোটা মূল্যায়ণ ও সম্মান করতেন। আমি কয়েকবার আব্বার সাথে সিএনজি করে শাহ সাহেবের ফাউন্ডেশন অফিসে গিয়েছি। তখনই ব্যাপারটা আঁচ করতে পারতাম।
আব্বার সাদামাটা জিন্দেগিতে অনেক কষ্ট সহ্য করতে দেখেছি। অনেক জায়গায় নিজেকে ছোট হতে দেখেছি শুধুমাত্র কুরআনের জন্য। নিজের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক কোনো আগ্রহ থেকে নয়; একান্তই আঞ্জুমানের জন্য নিজেকে তীলে তীলে ক্ষয়েছেন। এমন নজির আসলে পাওয়া অনেক কঠিন। আমার সৌভাগ্য এমন বাপের ছেলে হতে পেরে।
দেখেন! এটা বুঝা খুব সহজ যে, তিনি কতোটা আপন ছিলেন তার কাজের ব্যাপারে। বেশ কবার লন্ডনে গেলেন, অন্যান্য দেশও সফর করেছেন কিন্তু এসব সফর থেকে বিশেষ কোনো সুবিধাই আমাদেরকে ভোগ করতে দেননি। দেশব্যাপী ওয়াজ-মাহফিলেও যেতেন। যেখান থেকে যা পেতেন সবই আঞ্জুমানের জন্য ব্যয় করতেন। সুযোগ ছিলো, তিনি চাইলে এই সিলেট শহরে ক’টা বাড়ি-গাড়ি করতে পারতেন, সেটাও করেননি।
আমরা এখনো অনেক স্ট্রাগল করি। সার্ভাইব করতে শিখে গেছি। রাত-তিন পরিশ্রম করি। বাপের নাম বেঁচে খাই না, তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকেও খাই না। আমাদের এই পরিশ্রম করা বন্ধ করে দিলে অনিশ্চিয়তায় কাটাতে হবে। সবই ঠিক। কিন্তু রিজিকতো আল্লাহর পক্ষ থেকে। তিনিই সব ব্যবস্থা করবেন। এবং আমরা আমাদের বাবার প্রতি খুশী যে তিনি আমাদেরকে ‘জীবন’ কাকে বলে শেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এবং সেখান থেকে উত্তরণ হতে যে যোগ্যতা দরকার তা আমাদের শিখিয়ে গেছেন।
শাহ সাহেব কারো ছেলে হিসেবে বড় হননি, তিনি তাঁর নিজ যোগ্যতায় বড় হয়েছেন। তিনি নিজেই একটা বড় ব্রান্ড। আঞ্জুমারে পরিচয়টা খুব জরুরি ছিলো না। তাকে আব্বা রাহিমাহুল্লাহ বুকে টেনে এখানে এনেছিলেন। আসলে তার যোগ্যতা অনুমান করতে হলেও যোগ্যতার দরকার আছে। একজন কর্মমুখর প্রোডাক্টিভ মানুষ। তাঁর বিচারিক যোগ্যতা, সমাজিক চলাফেরা, আলোচনার প্যাটার্ন অতুলনীয়।
আব্বার ইন্তেকালের পর আমাদের পরিবারের খোঁজখবর রাখতেন। আমাদেরকে ভালো পরামর্শ দিতেন। আমরা হয়তো সেভাবে নিতে পারিনি। অথবা সহ্য করিনি। আমার যদি সুযোগ থাকতো বাবার প্রতিষ্ঠিত কমপ্লেক্সে শাহ সাহেবকে আরো বেশি সম্মান করার তাহলে সেটা আমি করতাম। এটা কোনো সুবিধার জন্য নয়; বাবার আদর্শ হিসেবেই।
শাহ সাহেব আব্বা রাহিমাহুল্লাহ থেকে খেলাফতপ্রাপ্ত। একজন মুখলিস বুযুর্গ। সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়েও, উম্মাহর ফিকিরে সদা মশগুল। একজন কর্মতৎপর মানুষ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। ইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে। বেশ ক’দিন হলো জ্ঞান ফিরেনি। গতকাল শুনেচ্ছি কিছুটা উন্নতির দিকে। আল্লাহ তাঁকে রহম করুন। সুস্থতার নিয়ামত দান করে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিন।
ইবাদ বিন
শাইখুল কুররা মাওলানা আলী আকবর সিদ্দিক
[পীরসাহেব ভানুগাছী রাহিমাহুল্লাহ]
১ মার্চ ২০২৫