শায়খে ভানুগাছীর তাসাউফ চর্চা ও তাঁর মুর্শিদ শায়খে মাধবপুরী রাহ.
আঞ্জুমানের সাংগঠনিক যাত্রা

বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে সুফিসাধক বা ইসলাম প্রচারকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য এক স্বর্ণালী ইতিহাস। এ দেশে ইসলাম পৌঁছার ক্ষেত্রে পীর-মাশায়েখ ও দরবেশদের অক্লান্ত মেহনতের মাধ্যমে নাজুক সময়ে ঘুণেধরা সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি সংস্কারে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। মসজিদ, মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও খানকাহভিত্তিক ধর্মচর্চা মুসলমান ও নওমুসলমিদের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিলো। আজকের ইসলামপন্থার সহজীকরণে তাঁদের ত্যাগ স্মরণ করতেই হবে।
বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের সুমহান বাণী পৌঁছে দিতে পীর ও মাশায়িখে এজাম দিনের পর দিন মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। তাঁদের ঘামঝরা পরিশ্রমের ফলে দীনের সহিহ সমঝ খুব সহজেই বাঙালি মুসলিম সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শাইখুল আরব ওয়াল আজম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি রাহিমাহুল্লাহর অবদান ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
শায়খ মাদানি রা.’র সিলসিলা ধরে বাংলাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে ধর্মচর্চার ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। তাঁর আধ্যাত্মিক খেলাফতপ্রাপ্ত আকাবির শায়েখরা রূহানিয়াতের এক অনুপম যাত্রা শুরু করেছিলেন। এরই ধারবাহিকতায় কুতবে দাওরান, মুজাদ্দিদে জামান মাওলানা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রাহিমাহুল্লাহ ১৯৪১ সালে দেওবন্দ থেকে দাওরায়ে হাদীস শেষ করে দেশে প্রত্যাবর্তনকালে হুসাইন আহমদ মাদানি রহ. আধ্যাত্মিকতার খেলাফতি পেয়ে নিজ এলাকায় তাসাউফ চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন।
পীর-মাশায়েখরা দীনের কাজ বৃদ্ধির জন্য সৌভাগ্যবান কিছু বুযুর্গদের আধ্যাত্মিক কাজের ইযাজত প্রদান করেন। শায়খে বর্ণভী রাহিমাহুল্লাহর ইযাজতপ্রাপ্তদের মধ্যে অন্যতম হলেন পীরে কামিল মাওলানা আব্দুর রহমান শাওকী শায়খে মাধবপুরী রাহ.। যদিও শায়খে মাধবপুরী মাদানী রাহ. ও তাঁর ইন্তেকালের পর হযরত বশির আহমদ শায়খে বাঘা রাহ. এর কাছে বায়াত ছিলেন। মাদানী রাহ. অসিয়ত অনুযায়ী শায়খে বর্ণভী রাহ. শায়খে মাধবপুরীকে খেলাফত দিয়ে ধন্য করেন।
শায়খে মাধপুরী ও শায়খে ভানুগাছী
শায়খে ভানুগাছী রহ. ছাত্রাবস্থায়ই ইলমে তাসাউফের সাধনা শুরু করেন। নিয়মতান্ত্রিকভাবে ইলমে তাসাউফ অর্জনের লক্ষে কুতবে জামান লুৎফুর রহমান শাইখে বর্ণভী রহ.-এর নিকট বায়াত গ্রহণ করেন। শায়খের ইন্তেকালের পর তাঁর বিশিষ্ট খলিফা হযরত মাওলানা আব্দুর রহমান শাওকী শায়খে মাধবপুরী রাহ. এর কাছ থেকে ইজাযত লাভ করেন। সমসাময়িক আকাবির হযরতদের সোহবপ্রাপ্ত থাকলেও আধ্যাত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠে শায়খে মাধবপুরী রাহ. এর সাথে।
কুতবে জামান শায়খুল মাশায়েখ হযরত মাওলানা লুৎফুর রহমান শায়খে বর্ণভী রহ.-এর খেদমতে অনেক সময় কাটাতে পেরে তিনি গৌরবান্বিত ছিলেন। তাঁর অনেক সফরের একান্ত সাথী ছিলেন। একবার আব্বা রাহিমাহুল্লাহর সাথে বরুণার বার্ষিক মাহফিলে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। বরুণার সাথে যে তাঁর আধ্যাত্মিক বন্ধন ছিলো, তা অনুভব করতে পেরেছিলাম।
যুগেযুগে আল্লাহপাক মহান ব্যক্তিদের পাঠিয়ে উম্মাহর সঠিক রাস্তা প্রদর্শন করেন ও পীর-মাশায়েখের দ্বারা তাঁর দ্বীনের খেদমত জারি রাখেন। তৎসময়ে উল্লেখযোগ্য বুযুর্গদের মধ্যে শায়খুল কুররা মাওলানা আলী আকবর সিদ্দিক শায়খে ভানুগাছী রাহিমাহুল্লাহও একজন মুখলিস পীর ছিলেন । তাঁর অসংখ্য ভক্ত-মুরীদ বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে বিরাজমান। বিশেষ করে তাঁর ভক্ত-মুরীদ সিলেটে, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, চাঁদপুর ও রাজশাহী জেলাতে।
আঞ্জুমানের সাংগঠনিক যাত্রা
আঞ্জুমানে তা’লীমুল কুরআন বাংলাদেশের সাংগঠনিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৮১ সালে। বরুণা মাদরাসার ছালানা ইজলাসে শায়খুল কুররা মাওলানা আলী আকবর সিদ্দিক রাহ. এর পরিচালনায় তাঁর পীর ও মুর্শিদ মাওলানা আব্দুর রমান শাওকী রা. এর সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে আঞ্জুমানে সাংগঠনিক যাত্রা শুরু হয়। ৯ সদস্য বিশিষ্ট পুর্ণাঙ্গ একটি কমিটি গঠন করা হয়। আলহামদুলিল্লাহ।
সেদিনের বৈঠকে সভাপতি করা হয় শায়খে মাধবপুরী রাহিমাহুল্লাহকে। তিনিই আঞ্জুমানের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রথম সভাপতি। টানা ৩০ বছর আমৃত্যু আঞ্জুমান সভাপতি ছিলেন। মুর্শিদের প্রতি কতোটা শ্রদ্ধা এবং সম্মান থাকলে এতো লম্বা সময় একসাথে কাটানো যায় তার একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত এটি। আঞ্জুমানের অগ্রগতির পেছনে শায়খে মাধবপুরীর নেক দুআ শায়খে ভানুগাছীর বড় এক সম্বল ছিলো।
কমিটি গঠন কিছুদিন আগে হলেও আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮২ সালে শায়খুল হাদীস আল্লামা নূর উদ্দীন আহমদ গহরপুরীর ইযাজত ও দুআর মধ্য দিয়ে। এই কমিটিকে সামনে রেখেই বুযুর্গানে দীনের আন্তরিক দুআ নিয়ে বালাগঞ্জ জামে মসজিদে ১৪০২ হিজরির রমজানে (১৯৮২ সালে) প্রথম আঞ্জুমানের কিরাআত প্রশিক্ষণের কার্যক্রম শুরু হয়।
আব্বা রাহিমাহুল্লাহর আধ্যাত্মিক রাহবার শায়খে মাধবপুরী রাহিমাহুল্লাহর ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত তাঁর একান্ত সোহবতে ধন্য হয়েছি। খুবই সাদা দিলের মুখলিস বুযুর্গ ছিলেন। প্রচারবিমুখ নিরব সাধক আল্লাহর এক খাস ওলী ছিলেন শায়খে মাধবপুরী রাহ.। আজকাল এমন মহান মনীষী পাওয়া দুষ্কর। অসুস্থ অবস্থায়ও আঞ্জুমান কমপ্লেক্সে কয়েকদিন অবস্থান করে শায়খে ভানুগাছী ও আঞ্জুমানের জন্য দুআ করতেন। তাঁর সদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারা আজো মনে পড়ে। আমাদের সাথে খুবই মায়া করে মজা করতেন। আমরা তাঁকে দাদা বলে সম্বোধন করতাম।
মাধবপুরীর সাথে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক
শায়খে মধবপুরী রাহ. এর সাথে আমাদের পারিবারিক সম্পর্কও হয়ে যায়। হয়তো আশিক-মাশুকের সম্পর্ককে আরো গাঢ় করবার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকেই সিদ্ধান্ত এসেছে। শায়খে মাধবপুরীর মেয়ের ঘরের নাতনীর সাথে শায়খে ভানুগাছীর সাহেবজাদা ও আমাদের বড় ভাই আঞ্জুমান সম্পাদক মাওলানা কারী ইমদাদুল হকের সাথে ২০০৫ সালে আকদে নিকাহ সম্পন্ন হয়। ফলে শায়খে মাধবপুরী রাহ. দাদা থেকে হয়ে যান নানাজি।
শায়খে মাধবপুরী রাহিমাহুল্লাহ নিজ এলাকা মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মাধবপুরে তালিমুল কুরআন নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। বর্তমানে হযরতের সাহেবজাদা মাওলানা কারী নুরুল মুত্তাকীন জুনাইদ মামা এহতেমামের দায়িত্বে আছেন। উনার ছোট ভাই মাওলানা কারী খালেদ বিন শাওকী মামাসহ খুব সুন্দরভাবে তাঁর রেখে যাওয়া আমানতের দেখভাল করছেন। প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় উনাদের দুই ভাইয়ের পারস্পরিক বোঝাপড়া অনন্য ও সৌহার্দপূর্ণ।
দীনের একনিষ্ট দায়ী ও সুন্নাহ প্রতিষ্ঠার মহীরুহ প্রিয় নানাজি শায়খে মাধবপুরী রাহিমাহুল্লাহ ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১১ সালে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে পরপারে মাওলার সন্যিধ্যে চলে যান। দীনের অনন্য এই খাদিমকে আল্লাহ জান্নাতের আলা মাকাম দান করুন।
_____ ইবাদ বিন সিদ্দিক
৯ মার্চ ২০২৫। ৮ রমজান