ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব

পৃথিবীর যতো সৃষ্টি সবই স্রষ্টার অপার দান। এসব সৃষ্টি মানবজাতির জন্য একেকটি নিয়ামত। মানুষ ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ তথা সৃষ্টির সেরা জীব। এর জন্য আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে দান করেছেন বিশেষ নিয়ামত। অগণিত সৃষ্টির মাঝে মানুষকে দিয়েছেন অফুরন্ত কুদরতি নিদর্শন। এর মধ্যে ভাষা আল্লাহ তাআলার অকৃপণ দান ও নিদর্শন। সেরা মানুষের জন্য সেরা একটি নিয়ামত ‘ভাষা’। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা-৩০ রুম, আয়াত: ২২, ২১)।

ভাষা মানুষের পরিচয়ের বিশেষ এক বৈশিষ্ট্য। ইসলাম সব ভাষাকেই সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে। সব ভাষাই আল্লাহ তাআলার দান। বিদায় হজের ভাষণে মহানবি হযরত মুহাম্মদ সা. বলেছেন, ‘কালোর ওপর সাদার প্রাধান্য নেই, অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ (বুখারি শরিফ)। এই হাদিস দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায়, অন্য ভাষার প্রতি ইসলামের কোনো বৈষম্য নেই। ভাষাগত বিষয়ে ইসলাম সর্বজনীন। সুতরাং কোনো ভাষাকে হেয় জ্ঞান করা যাবে না, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যাবে না এবং অবহেলা করা যাবে না; কেননা, ভাষার স্রষ্টা মহান আল্লাহ। পাকিস্তান আমাদের উপর উর্দুকে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলো, যেটি ছিলো অন্যায়। প্রত্যেক মানুষ তার নিজ দেশের ভাষা চর্চা করবে এটাই স্বাভাবিক। ইসলামও তাই সমর্থন করে। মাতৃভাষা আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া মানবজাতির জন্য নির্ধারিত।

আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক নবির কিতাব তাঁর ভাষাতেই অবতীর্ণ করেছেন। হযরত মুসা আ. এর ওপর তাওরাত অবতীর্ণ করেছেন হিব্রু ভাষায়, হযরত দাউদ আ. এর ওপর জবুর অবতীর্ণ করেছেন ইউনানি ভাষায়, আর হযরত ঈসা আ. এর ওপর ইঞ্জিল অবতীর্ণ করেছেন সুরিয়ানি ভাষায়। সর্বকালের সর্বশেষ্ট মহামানব শেষ নবি হযরত মুহাম্মদ সা. এর ওপর সর্বশ্রেষ্ঠ গন্থ আলকুরআন অবতীর্ণ করেছেন আরবি ভাষায়। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনেও এ কথা বলেছেন- ‘আমি প্রত্যেক নবিকেই তাঁর নিজ নিজ জাতির ভাষায় প্রেরণ করেছি; যেন তিনি তাদের সুস্পষ্টভাবে বুঝাতে পারেন।’ (সুরা-ইব্রাহিম আয়াত : ০৪)

মানুষের হিদায়াতের জন্য আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে যত নবি রাসুল প্রেরণ করেছেন, তাঁদের প্রত্যেককেই তাঁদের মাতৃভাষায় বা স্বগোত্রীয় ভাষায় প্রেরণ করেছেন। যাতে তাঁরা তাঁদের জাতিকে সুস্পষ্ট ভাষায় আল্লাহ তায়ালার হুকুম বুঝাতে পারেন এবং মানুষও নবি রাসুলের ভাষা বুঝে আমল করতে পারে। ভাষার যে সম্মোহনী শক্তি রয়েছে তা কেবল প্রকাশ প্রায় আপন মাতৃভাষায়। ভিন্ন ভাষায় মনের ভাব সফলভাবে প্রকাশ করা যায় না। অতএব মাতৃভাষার গুরুত্ব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তাৎপর্যপূর্ণ।

মহাগ্রন্থ আলকুরআন আরবি ভাষায় নাজিল করার কারণ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা স্বয়ং ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘এটি আমি অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায়, যাতে তোমরা বুঝতে পারো।’ (সুরা-১২ ইউসুফ, আয়াত: ২)। অর্থাৎ আরবদের কাছে আরবি ভাষাভাষীর নবি ও আরবি কিতাব আলকুরআন নাজিল করা হয়েছে। কারণ, তাদের মাতৃভাষা আরবি; অনারবি ভাষায় নাজিল করলে তাদের বুঝতে ও অনুসরণ করতে সহজ হবে না। এ থেকে বুঝা যায়, মাতৃভাষা সম্পর্কে ইসলাম কতোটা গুরুত্ব দিয়েছে।

ধর্ম প্রচারে শুদ্ধ ভাষা ও সুন্দর বর্ণনার প্রভাব অনস্বীকার্য। হযরত মুসা আ. তাঁর ভাই হযরত হারুন আ.-কে নবি ও রাসুল হিসেবে ঘোষণা করার জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন করলেন। কারণ তিনি ছিলেন বাগ্মী, শুদ্ধ, স্পষ্টভাষী ও সুবক্তা। এবং তিনি আল্লাহর একত্ববাদ ও দীনের বক্তব্যকে উত্তম বচনভঙ্গিতে খোদাদ্রোহী সম্রাট ফিরাউন ও তার সঙ্গিদের নিকট তুলে ধরবেন। অন্যদিকে মুসা আ. -এর মুখে ছিল জড়তা। তিনি তাঁর ভাইর ব্যাপারে বলেন ‘হুয়া আফসাহু মিন্নি।’ অর্থাৎ সে আমার অপেক্ষা বাকপটু। ভাষার গুরুত্ব বুঝাতে হযরত মুসা আ. এর বক্তব্যকে আল্লাহ তাআলা তা কুরআনে উল্লেখ করে বলেন, ‘আমার ভাই হারুন, তিনি আমার থেকে অনেক বেশি প্রাঞ্জলভাষী। তাই আপনি তাকে আমার সহযোগী করে প্রেরণ করুন; যাতে সে আমাকে (দাওয়াতের ক্ষেত্রে তার প্রাঞ্জল ভাষার দ্বারা) সত্যায়িত করে। কেননা আমি আশঙ্কা করছি (আমার বক্তব্য সত্য হওয়া সত্বেও) তারা আমাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করবে।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ৩৪)

মাতৃভাষার প্রতি প্রতিটি মানুষের ভালোবাসা বিদ্যমান। এ ক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাসের কোনো ইস্যু নেই। ইসলাম সব ভাষাকে সম্মান করার কথা বলে। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এ দেশের মানুষকে ভিনদেশি ভাষার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে চেয়েছিলো। কিন্তু এ দেশের জনগণ তা হতে দেয়নি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানির হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল এদেশের সালাম, রফিক ও জাব্বারদের মতো একদল দেশপ্রেমী তারুণ্য। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে মুখর করে তোলে রাজপথ। এভাবে মাতৃভাষার জন্য রক্তদান বা শাহাদতবরণের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা, রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি লাভ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় ভূষিত হয়।

ইসলামপ্রিয় মুসলমানের জন্য বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার বিকল্প নেই। আজ আমরা বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে মাতৃভাষায় দীনের দাওয়াত, কুরআন ও সুন্নাহর বাণী পৌঁছাতে সক্ষম হচ্ছি শহিদদের তাজা রক্তের বিনিময়ে। সে জন্য আল্লাহর তাআলার কাছে সব ভাষাশহিদের মাগফিরাত কামনা করি। আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে জান্নাতে উচ্চমর্যাদায় রাখুন। পাশপাশি আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে বিশুদ্ধ মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে দীনের দাওয়াতি কাজ করার তাওফিক দান করুন।

লেখাটি দৈনিক সিলেট মিরর-এ প্রকাশিত। (১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২)

Related Articles

Back to top button
error: Content is protected !!