স্বপ্নের সাম্পান

শাওনের রাত। পায়ের নিচে কাদাজল, কাঁচা পানিতে ধোয়া হিম বাতাস,বাতাসে শব্দ নেই, এখন বাঁশবন পাড়ি দিচ্ছেন, অবশ্য পাতার বাঁশি টাইপ এক ধরনের শরশর শব্দ শোনা যাচ্ছে, যেন চাঁদকে কন্যা দেখতে আসবেন, এ রকমই লাজুক তিনি। একটু পরে পরে মেঘবতীর আঁচলে মুখ লুকোচ্ছেন ।

তিনি যেখানে যাচ্ছেন ঐ জায়গাটার নাম দিয়েছেন ‘জোছনা পাড়া’। ওখানে গেলে খুব সুন্দর জোছনা দেখা যায়। জোছনা গাছে থাকে, গাঙে থাকে, কুঁড়েঘরের আধোভাঙ্গা খিড়কী বেয়ে পড়তে থাকে। ঘাসের মুক্তোজলে হীরক মণির মতো জ্বলতে থাকে। জোছনা পুকুরের নিথর জলরাশির পিঠে থাকে, আর থাকে মেঘের ওপর ।

জোছনা এখন মেঘের ওপর। মেঘের সাথে মাখামাখি মিতালি। পৃথিবীর সব মানুষ ঘুমিয়ে গেছেন। তিনি একা, দূর থেকে কোথাকার কোনো এক অতন্দ্র বিরাগী রাখালের পোঁড়া বাঁশীর একটা বিক্ষত সুর এসে কানে বিঁধছে, দূরাগত শীতার্ত শেয়ালের ভাঙ্গা কান্না অতলান্তে থেকে থেকে আছড়ে পড়ছে। পাড়ায় ঢুকলেন। মনটা ভেজা পদ্মের পাপড়ির মতো হয়ে উঠেছে, ভারী এবং শীতল। তবে মোলায়েম এবং সজিব।

পাড়ার ভেতর নদী, যেন এক উতলা নন্দিনী, যেন কত ক্লান্তির পর ঘুমিয়েছেন তিনি। নদীর দুপারে দুটো বাড়ি। বাড়ির সামনে দুটুকরো কাঠের ওপর খোদাই করে বাড়ি দুটির নাম লিখে রাখা। এক বাড়ির নাম ‘চাঁদনী’ আর অপর বাড়ির নাম ‘সবিতা’। চারদিকে সবুজের বন, উঁচু উঁচু জংলী গাছ, নদীর পারে হিজল আর ঝাউবনের গহীনে নির ঝুম ঝুম নিরবতা। সর্বত্রে সাদা জোছনা ছিটিয়ে আছে। গাছের ঢালে কয়টা রাত্রিচর বিহঙ্গের মন-মাতানো সুরের লহরী পাড়া মাতিয়ে তুলছে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে শুভ্র সাগরিকার শ্বেত পাপড়িয়াল নকশী নিয়ে ঘুমিয়েছে নিভৃত এই বনভূমি। সব মিলিয়ে সবুজের স্বপ্নপুরীর মতো দাড়িয়ে আছে দু’পারের দুই বাড়ির এই দেশ। নদীর ওপর বাঁশের তৈরি একটা সাঁকো আছে। এক পাশে বাঁধা একটি পানসী তরী। নৌকোটির গায়ে নদীর পানির মত নীল রংয়ে বাহারি ফুল আঁকা।

রাত যখন গভীর হয় নদীর ঠিক মধ্যখানে সাঁকোর ওপর এসে দাড়ান তিনি। আকাশে পূর্ণ চন্দ্র, ঝিলমিল ঝিলমিল জল-তরঙ্গ, জোছনায় জোছনায় ভেসে যাচ্ছে দুনিয়া। ওপারে সবিতা এ পারে চাঁদনী। সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে আছেন, হিমেল হাওয়ার ঠান্ডা পরশে শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে, নয়ন মুগ্ধ হচ্ছে প্রকৃতির প্রণয়োচ্ছ্বাসে, অনুভূতির রাজ্যটা স্বপ্নের পাড়ার এই চির সুন্দর মোহনার স্নিগ্ধাচার আবেগে আকূল করে তুলেছে। সেই কখন থেকে একটা মন্থর তালে এখনো অবিরাম বাতাসে ভেসে আসছে সেই পোড়া বাঁশির মর্মপীড়ক সুরটি ।

কী এক অবর্ণনীয় ব্যাঞ্জনময়তায় হৃদয়ে অনুরাগের মাতম উঠছে। নদীর ওপারে চোখ রাখলেন, সবিতার ঘাটে বাঁধা ছোট্ট পানসিটা জলছোঁয়া সমীরের মৃদু হিল্লোলে দুলছে, জোছনার ফুলে ভরে গেছে নৌকোর গলুই। ঘাটের পাশে সবিতার ছোট্ট কুঠির লতায়িত হয়েছে কত শত জংলী ফুলে। ঘর নয়, যেন একটি পুস্পকুঞ্জ। দখিনের জানালাটা ময়ূরের পালক দিয়ে সাজানো। দরজার কপাট দু’টোও বনের বাহারী সবুজ-শক্ত পাতা দিয়ে বাঁধানো ।

ওপারে চোখ রাখলেন, এ বাড়ির নাম চাঁদনী। এ বাড়িটিও ঠিক এ রকমই সাজানো। তবে কোথাও যেন একটু পরিবর্তন রাখা হয়েছে, যেমন, ঘরখানি চাঁদনীর রংয়ে অনেকটা নিখুঁত শুভ্র বসনে মোড়া। দাঁড়িয়ে ভাবলেন, তিনি বর, এ বাড়িটা বরের আর ওপারেরটা কন্যার বাড়ি।

ঘাটের পাশে পাতার তৈরি একটা ডাকবক্স রাখা। বক্সের ভেতর জোছনারাতে নন্দিনী একটা নিমন্ত্রন-পত্র লিখে রাখেন, ‘ওগো, আজ বিস্তর জোছনা পড়েছে চারিদিকে, রতভর গল্পময় অভিসার হবে, আজ আমার কুঠিরে তোমার নিমন্ত্রণ।’

ওপার থেকে রাজপুত্র ধীর পায়ে এগিয়ে এসে চিঠিখানি পড়েন। একটু মুচকি হেসে আবার চাঁদনীতে চলে যান। শাহী পোষাক পরে শরীরে সুরভি আতর মেখে হর্ষিত মনে গহীন রজনীতে এগিয়ে আসেন সবিতার দিকে। দেখেন বাঁশের সাঁকো ধরে সাদা শাড়ি পরে রূপালী মুখে দাঁড়িয়ে আছে তার নন্দিনী ।

এটা তাদের নিয়ম। বাড়ি দুটিই দুজনের। বিয়ের পর থেকেই তারা এ রকম স্বপ্নের পাড়া গড়েছেন। দুজন রাতের বেলা এক কুঠিরেই রাত কাটান। তবে তা স্বপ্নীল মমতার অনন্য নৈসর্গিকতায়। একজন ওপরজনকে প্রতিটি সন্ধায় একেকদিন একেকটা নিয়মে নিমন্ত্রণ-পত্র লিখে নিয়ে আসেন ।

আজ নন্দিনীর ‘সবিতায়’ নিমন্ত্রণ পেয়ে রাজপুত্র আসছেন। কাল রাজপুত্র একটি পত্র লিখে নন্দিনীকে দাওয়াত করে নিয়ে যাবেন। এভাবে পালা করেই সংসারের সুখ ভাগ এবং ভোগ করছেন তারা। যেন প্রতিদিন একটা একটা নতুন প্রেম হয় দুজনের!

সাঁকোর মধ্যখান থেকে এগিয়ে নিচ্ছেন রাজপুত্রকে। কুঠিরে বসে গল্প হবে, হবে হাসি-আনন্দের একান্ত আলাপন, হবে দেহ মন প্রাণের সর্বশ্রেষ্ট ভালবাসা বুনন। তারপর অন্তিম রাতে তারা বেরিয়ে পড়বেন জোছনা বিলাসে। কিছুক্ষণ পানসিতে চড়ে নীল ¯্রােতস্বিনীর বুক চিরে এঁকে যাবে চিরন্তন ভালবাসার রেখা ।

এখনো প্রায় পাঁচ হাত জায়গা পুল পাড়ি দিয়ে নন্দিনীর হাত ধরবেন রাজপুত্র। মনের ভেতর কী মধুর উন্মাদনা। পুলের ওপর একটু এগিয়ে এসে ওপারে দাড়িয়ে গভীর নয়নে তাকিয়ে আছে নন্দিনী। ছোট্ট বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে আসছেন রাজপুত্র। ওপার থেকে সাহস দিচ্ছে নন্দিনী। ‘আর একটু জায়গা, এই তো এসে গেছ!’

অবিরাম শীতল বাতাস বইছে। চাঁদের নরম আলোর কী অপূর্ব ক্ষরণ, স্পষ্ট নন্দিনীর মায়াবী নিটোল মুখখানি দেখা যাচ্ছে, যেন কোনো শ্বেত মূর্তিতে জোছনার আলো ঠিকরাচ্ছে। বিমুগ্ধ নয়নে নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে সাঁকো পেরুচ্ছেন রাজপুত্র। একদম কাছে এসে গেছেন। গভীর প্রেমের টানে রাজপুত্রের হাতখানি ধরতে চেয়েছেন নন্দিনী।

আর ধরার দরকার নাই। স্বপ্নের হাত ধরে স্বপ্নরা এগিয়ে যাক। একজন নিরন্তর স্বপ্নবাজ সমাজ চিন্তার সাহসী সহচর প্রিয় মানুষ ইবাদ বিন সিদ্দীক।

পুনশ্চ : গল্পটা একজনকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলাম। করতে পারলাম না, থাক। কত না পারা নিয়েই তো মানুষের জীবন।হ্যাঁ, হয়তো আপনাকেই উৎসর্গ করে দিলাম। আপনাকেই। যে আপনি কথাগুলো পড়ে একটু থমকে গেছেন…।

আযাদ আবুল কালাম
লেখক : সম্পাদক, সৃজনঘর

Scroll to Top