‘আবেগ তো সেই কবেই আত্মহত্যা করেছে। এখন শুধু স্মরণসভা হয়।’
(ইবাদ বিন সিদ্দিক, আপনাদের সমীপে যাহা বলিতে চাই; ফেস্টুন, ২০২০)
বাক্যটি পড়ার পর এই প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবেই যে-কারো মনের ভেতর জাগবে—আবেগ কি নিজেকে নিজে হত্যা করতে পারে? এই যে আপনার মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হলো, ভাবনার জন্ম হলো, চিন্তার সূত্রপাত ঘটলো, এটাই ইবাদ বিন সিদ্দিকের শক্তি। মুহূর্তেই চিন্তার জগৎকে উস্কে দেওয়ার শক্তি তার আছে। দুহাজার বিশ সালের একুশে বইমেলায় ফেস্টুন থেকে যখন ইবাদ বিন সিদ্দিকের ‘আপনার সমীপে যাহা বলতে চাই’ প্রকাশ হয় তখনই বিষয়টি সবার নজরে আসে। যদিও আমরা যারা তার কাছের লোকজন তারা বই প্রকাশের আগ থেকেই তার এই শক্তির সাথে পরিচিত।
নিয়ন্ত্রিত এই সময়ে আমাদের সমাজের চিন্তক, বুদ্ধিজীবী বা শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যখন স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে দায়িত্ব থেকে দূরে আছেন, তখন আমাদের মধ্য থেকে একজন ইবাদ বিন সিদ্দিক জেগে ওঠেন। সমাজের অসঙ্গতিগুলোকে চিহ্নিত করে প্রশ্ন ছুড়ে দেন। বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে চিন্তার মুক্তির আকাক্সক্ষায় সমাজের মগজে কথার বুলেট দ্বারা করেন তীক্ষè আঘাত। ইবাদ বিন সিদ্দিকের এমন উস্কানিমূলক আঘাতে নড়েচড়ে ওঠে চৈতন্য হারিয়ে স্রোতের তালে ভাসতে থাকা বিবেক।
এই সমাজ ভ্রষ্ট এই দাবিটা আমরা সবাই করি। চলমান সমাজ ভেঙে নতুন সমাজ নির্মাণের জন্য আমরা কথা বলি। কিন্তু নতুন সমাজ গড়ার জন্য যে জিজ্ঞাসা বা প্রশ্নাত্মক আলোচনার দরকার তা থেকে আমরা দূরে থেকেছি সবসময়। তরুণ চিন্তক ইবাদ বিন সিদ্দিক এসে আমাদের অপূর্ণ কাজটা পূর্ণ করার দায়িত্ব নিলেন। তিনি সমাজ-দর্শন নিয়ে জিজ্ঞাসা তৈরি করলেন। তার জিজ্ঞাসা এই সময়ের জন্য ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। তার জিজ্ঞাসা বা প্রশ্নাত্মক আলোচনা নতুন চিন্তকদের উপকরণ হবে।
ইবাদ বিন সিদ্দিক আপনাদের সমীপে যাহাবলতে চাই বইয়ে লিখেছেন—
‘কৃত্রিমতা সবসময়ই অগ্রহণযোগ্য। মূল্যহীন। কৃত্রিমতা আমাদের গিলে খাচ্ছে। রুচিবোধ, ভালোবাসা, প্রেম সবই দুষ্প্রাপ্যতার বাজারে হারিয়ে যাচ্ছে। ভণ্ডামিতে ছেয়ে গেছে সমাজ।’
ইবাদ যে অভিযোগটা এনেছেন তা কি উড়িয়ে দেওয়া যাবে? অন্তর্জালের আধিপত্যের এই সময়ে মানুষ কি ক্রমশ কৃত্রিম হয়ে ওঠছে না? মানুষের আবেগ, ভালোবাসা, প্রেম, দ্রোহ সব কিছুতেই এখন কৃত্রিমতার ছড়াছড়ি। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে মানুষ বাহিরে যেটা প্রকাশ করছে ভেতরে সেটা ধারণ করছে না। সমস্তকিছু গ্রাস করে আছে ভণ্ডামি।
এই যে আমরা করোনার মতো ভয়ঙ্কর অতিমারির মুখোমুখি হলাম এর দায় কার? ভণ্ড পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের নয় কি? ভণ্ড পুঁজিতান্ত্রিকরা ডেভেলাপমেন্ট বা উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে পরিবেশকে বিপন্ন করছে ক্রমাগত। আর ক্ষমতা ও শক্তির রক্তচক্ষুর সামনে আমরা নিরবে সয়ে যাচ্ছি সবকিছু। আমাদের রুখে দাঁড়াবার দায় নেই। আমাদের বিবেক জাগে না। আমাদের চোখের সামনে উন্নয়েনর নামে কৃষক-শ্রমজীবী মানুষকে চোষে
খাচ্ছে পুঁজিপতিরা। আমরা সব জেনেও না জানার বান করে বসে আছি। কিন্তু এভাবে আর কত দিন?
আমরা এখন যে সময়টায় বসবাস করছি এই সময়ে এমন সৃজনশীল চিন্তার মানুষ পাওয়া খুবই কঠিন। এই অন্তর্জালের আধিপত্যের সময়ে মিথ্যা, অপবাদ আর আবেগের অতি চাষাবাদ হচ্ছে। স্রোতে গা ভাসিয়ে চলার সময় এটি। সুন্দর সমাজ নির্মাণের জন্য শুদ্ধ চিন্তার মানুষের প্রয়োজন, কিন্তু চিন্তার জগতে মানুষের পদচারণা কমছে দিন দিন। সভা, সেমিনার, মাহফিলের অভাব নেই এই সময়ে। অভাব শুধু চিন্তক আর মননশীল মানুষের।
এমন কঠিন সময়ে গণ্ডীর এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেঙে তরুণ চিন্তক ইবাদ বিন সিদ্দিক এগিয়ে এসেছেন। সমাজ-ধর্ম, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, পরিবার, সংস্কৃতি নানা বিষয় নিয়ে লিখেছেন তিনি। বৃত্ত ভেদ করে উজান স্রোতে সাজিয়েছেন ভাবনার আপন জগৎ। ইবাদ বিন সিদ্দিকের এ যাত্রা অব্যাহত থাকুক। তিনি যেনো থেমে না যান এই আবদার থাকলো তার কাছে।
আলগা আলাপ : ‘ইবাদ ভাই, বিয়ে কবে করছেন?’ আমাদের সঙ্গে দেখা হলেই এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় তার। সৃজনশীল কাজ-কর্ম নিয়ে ব্যস্ত ইবাদ ভাইকে দেখে মনে হয়নি কখনো বিয়ে-শাদি নিয়ে তিনি খুব একটা ভাবেন। ‘বিয়ে কবে করছেন’ এই প্রশ্নের উত্তর সরসরি কখনো দেননি তিনি। যাক, অবশেষে তিনি যে একজন জীবনসঙ্গীর অভাব অনুভব করেছেন এটা আমাদের জন্য খুশির সংবাদ। মহীয়সী তাহমিদার সঙ্গে তিনি যুগল জীবন শুরু করতে যাচ্ছেন। ইবাদ-তাহমিদার দাম্পত্য জীবন হোক প্রেমময় এবং সুখ-সমৃদ্ধ। অনাগত দিনগুলো হোক প্রত্যাশিত সুন্দর।
নাওয়াজ মারজান
লেখক : শিল্পকর্মী ও প্রচ্ছদকারিগর